খেজুরের গুড় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী একটি খাদ্য, যা শীতকালের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষত বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি এই গুড়ের কদর অনেক বেশি। খেজুরের গুড় শীতের পিঠা-পায়েশ, মিষ্টি ও বিভিন্ন খাবারের স্বাদকে নতুন মাত্রা দেয়।

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিতে গুড়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে গ্রামবাংলায় গুড় তৈরির ধুম পড়ে যায়। পিঠা-পায়েশের পাশাপাশি বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরিতে খেজুরের গুড় অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

খেজুরের গুড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক মিষ্টি উপাদান থাকার পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। এতে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, এবং বিভিন্ন খনিজ উপাদান রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বিশেষত এটি আয়রনসমৃদ্ধ, যা রক্তস্বল্পতার প্রতিকার হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুরের গুড় তৈরির পদ্ধতিতে ভিন্নতা দেখা যায়। বিশেষত, যশোর, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং বরিশালের মতো জেলাগুলো খেজুরের গুড় তৈরির জন্য বিখ্যাত। প্রতিটি অঞ্চলের রস সংগ্রহের পদ্ধতি ও গুড়ের স্বাদে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

খেজুর গাছের রস সংগ্রহ

খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয় মূলত শীতকালে। শীত পড়া শুরু হলে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে খেজুরের রস সংগ্রহের উপযুক্ত মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। কারণ শীতকালে গাছের রস মিষ্টি হয় এবং তা থেকে গুড় তৈরি করা সহজ।

গাছের চূড়ার নীচে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় “চাচা” নামক একটি ছোট ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্রের মাধ্যমে রস ধীরে ধীরে বের হয় এবং তা পাত্রে জমা হয়। এ প্রক্রিয়াকে স্থানীয় ভাষায় “রস চাঁছা” বলা হয়। খেজুর গাছের চামড়া যতটা সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত না করে খুব যত্নসহকারে এই কাটা কাজ করা হয়, যাতে গাছের জীবনযাত্রা বজায় থাকে।

রস সংগ্রহের জন্য বাঁশের তৈরি মটকা বা মাটির কলসি ব্যবহার করা হয়, যা গাছের কাটা অংশে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এছাড়াও, একটি ধারালো দা বা দা-সদৃশ সরঞ্জাম দিয়ে গাছের গায়ে কাটা দেয়া হয়।

রস সংগ্রহের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। মটকা বা পাত্রটি প্রতিদিন পরিষ্কার করা জরুরি, যাতে রসে কোনো দূষণ না হয়। এছাড়াও, রস সংগ্রহের সময় গাছের পরিবেশ এবং তাপমাত্রার ওপরও নজর রাখা হয়, কারণ শীত বেশি হলে রস বেশি মিষ্টি হয়।

রস থেকে গুড় তৈরির প্রক্রিয়া

গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর সেটিকে বড় পাত্রে স্থানান্তর করা হয়। এই রস যতটা সম্ভব তাজা অবস্থায় গুড় তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়, কারণ পুরনো রস থেকে ভালো গুড় তৈরি হয় না।

রস বড় পাত্রে করে মাটির চুলায় ঢালা হয়। সাধারণত খোলা আঙিনায় চুলা তৈরি করে বড় পাত্রে রস জ্বাল দেয়া হয়। চুলার আঁচ মাঝারি রেখে রসকে ধীরে ধীরে ঘন করা হয়। এটি অত্যন্ত ধৈর্যের একটি কাজ, কারণ রস পুড়ে গেলে গুড়ের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।
রস গরম করার সময় এর উপরে একটি ফেনা দেখা দেয়, যা ধারাবাহিকভাবে তুলে ফেলা হয়। এটি রসকে পরিষ্কার রাখে এবং গুড়ের গুণগত মান বৃদ্ধি করে।

রস ধীরে ধীরে ঘন হয়ে জমাট বাঁধতে শুরু করে। যখন রস পুরোপুরি ঘন হয়, তখন এটি থেকে ফেনা তুলে ফেলা হয়। এ পর্যায়ে রসকে নাড়ানো বন্ধ করে দিয়ে সেটিকে ঠান্ডা হতে দেয়া হয়।

রসের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের গুড় তৈরি করা হয়। পাতলা গুড় সাধারণত তরল থাকে এবং এর সুমিষ্ট স্বাদ থাকে। ঘন গুড় কিছুটা আঠালো হয় এবং শক্ত গুড় পুরোপুরি জমাট বাঁধে, যা ছোট ছোট টুকরো করে খাওয়া হয়।

ভিন্ন ধরনের খেজুরের গুড়

খেজুরের গুড়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্য রয়েছে, যা মূলত গুড়ের প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি এবং রসের ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। নিম্নে বিশেষ কয়েকটি ধরণের গুড় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:

খেজুরের চকলেট বা বীজ গুড়

খেজুরের চকলেট গুড়কে অনেক এলাকায় “সন্দেশ গুড়” নামেও ডাকা হয়। এটি দেখতে চকলেটের মতো নয়; বরং এটি নির্দিষ্ট আকারের ছোট ছোট পাটালি আকারে তৈরি হয়। এর গঠন বেশ শক্ত এবং মজবুত। এই গুড়ের উৎপত্তি প্রক্রিয়ায় খেজুরের রসকে ঘন করে জমাট বাঁধিয়ে নির্দিষ্ট আকারে রাখা হয়, যা শক্ত ও মিষ্টি স্বাদের হয়। এই গুড় অনেক সময় পিঠা, পায়েশ এবং বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গুড়টি শক্ত ও ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ করার উপযুক্ত, কারণ এটি সহজে গলে না এবং দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

খেজুরের পাটালি গুড়

পাটালি গুড় হলো খেজুরের রস থেকে তৈরি এক ধরনের শক্ত গুড়, যা খেজুর গুড়ের সবচেয়ে প্রচলিত ধরন। খেজুরের রসকে জ্বাল দিয়ে যখন তা ঘন এবং জমাট বাঁধা হয়, তখন সেটিকে আয়তাকার বা গোলাকৃতিতে ঢেলে পাটালি আকারে তৈরি করা হয়। এই গুড় শীতকালে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক এলাকায় পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাটালি গুড়ের স্বাদ মধুর এবং এটি সহজে ব্যবহারের জন্য ছোট টুকরো করে বিক্রি করা হয়।

খেজুরের ঝোলা বা লালি গুড়

ঝোলা বা লালি গুড় খেজুরের রস থেকে সরাসরি তৈরি করা এক ধরনের আঠালো, তরল গুড়। এটি জমাট বাঁধে না এবং আকারে পাতলা থাকে। এর রঙ সাধারণত লালচে বা বাদামী হয়, এবং অনেক সময় একে “লালি গুড়” নামেও ডাকা হয়। ঝোলা গুড় সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং এটি সরাসরি চা বা পিঠায় মিষ্টি যোগ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। খেজুরের রসকে সামান্য জ্বাল দিয়ে এটি তৈরি করা হয় এবং এটি খেতে খুবই মিষ্টি ও সুগন্ধি হয়।

খেজুরের দানাদার গুড়

দানাদার গুড় দেখতে ঝোলা গুড়ের মতোই, তবে এতে ছোট ছোট দানা মিক্স করা থাকে। রসকে জ্বাল দেওয়ার সময় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এটিকে কিছুটা জমাট বাঁধানো হয়, যাতে গুড়ের ভেতর ছোট ছোট দানার মতো কণাগুলো তৈরি হয়। যদিও এটি পুরোপুরি জমাট বাঁধে না, ঝোলা বা লালি গুড়ের মতোই আঠালো থাকে। দানাদার গুড় সরাসরি খাওয়ার পাশাপাশি মিষ্টি এবং পিঠা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এর মিষ্টতা এবং আঠালো গঠন খেজুরের রসের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখে, যা এ গুড়কে বিশেষ করে তোলে।

গুড়ের রঙ সাধারণত হলুদাভ বা বাদামী হয়। রঙের এই ভিন্নতা রসের ঘনত্ব এবং প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। বেশি সময় ধরে জ্বাল দিলে গুড়ের রঙ গাঢ় হয়।

খেজুরের গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ রসের মিষ্টতা এবং রন্ধন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। এক এক অঞ্চলের গুড়ের স্বাদে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়, কারণ গাছের প্রজাতি ও জমির প্রভাব থাকে।

খেজুরের গুড় সংরক্ষণ

  • পাত্রঃ গুড় সংরক্ষণের জন্য সাধারণত মাটির পাত্র বা কাঁচের বোতল ব্যবহার করা হয়। মাটির পাত্রে গুড় বেশি দিন ভালো থাকে, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা থাকে।
  • স্থানঃ গুড়কে শীতল ও শুকনো স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। আলো ও আর্দ্রতা থেকে দূরে রাখতে পারলে গুড় দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
  • তাপমাত্রাঃ গুড়কে বেশি দিন ভালো রাখতে চাইলে তা একটি শুষ্ক স্থানে রাখা উচিত। আর্দ্রতা গুড়ের গুণগত মান নষ্ট করতে পারে। এজন্য গুড় সংরক্ষণের আগে তা পুরোপুরি ঠান্ডা করে নেওয়া জরুরি।

খেজুরের গুড়ের ব্যবহার

  • পিঠা-পায়েশ তৈরিঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন পিঠা-পায়েশ তৈরিতে খেজুরের গুড় অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত শীতকালে পিঠাপুলি তৈরিতে গুড় ব্যবহার করা হয়।
  • মিষ্টি তৈরিঃ গুড় থেকে নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি করা হয়, যেমন নারিকেলের গুড় মিষ্টি, গুড় সন্দেশ ইত্যাদি। গুড়ের মিষ্টি খাবারের স্বাদ আরও মধুর করে তোলে।
  • দৈনন্দিন খাবারে গুড়ের ব্যবহারঃ দৈনন্দিন খাবারে চা, পায়েশ, বা সাদা ভাতের সঙ্গে গুড় খাওয়া যায়। এটি চিনি বা মধুর বিকল্প হিসেবে স্বাস্থ্যকর।

গুড়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা

গুড় হজমের সহায়ক, রক্তশূন্যতা দূর করে এবং ঠান্ডা-কাশির মতো সমস্যায় উপকারী। এটি প্রাকৃতিক আয়রনসমৃদ্ধ হওয়ায় রক্ত স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

খেজুরের গুড়ের ব্যবসা

খেজুরের গুড়ের বাজার গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় এলাকায় সমান জনপ্রিয়। শীতের সময় গুড়ের চাহিদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। গুড়ের দাম রস সংগ্রহের মৌসুম ও গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত পাতলা গুড়ের দাম একটু কম, শক্ত গুড়ের দাম বেশি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুড় আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি হয়। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এর চাহিদা বেশ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুড় তৈরি একটি লাভজনক ব্যবসা। যেসব পরিবার খেজুর গাছের মালিক, তারা প্রতি শীতে বড় অঙ্কের আয় করে।

উপসংহার

খেজুরের গুড় আমাদের ঐতিহ্যের অংশ এবং খাদ্য তালিকার একটি মিষ্টি উপাদান। এটি শুধুমাত্র মিষ্টি নয়, স্বাস্থ্যকর উপাদানও। ভবিষ্যতে খেজুরের গুড়ের উৎপাদন ও ব্যবসায় আরও প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে গুড়ের বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব। গুড় উৎপাদন ও সংরক্ষণে আমাদের দায়িত্ব হলো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং গাছের যত্ন নেওয়া।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *